মোটরযান স্ক্র্যাপ নীতিমালা: সড়কের ৪০ শতাংশ বাস ধ্বংসযোগ্য

Passenger Voice    |    ১১:৩৯ এএম, ২০২৩-০৬-১৮


মোটরযান স্ক্র্যাপ নীতিমালা: সড়কের ৪০ শতাংশ বাস ধ্বংসযোগ্য

দেশের সড়কগুলোতে চলাচল অনুপযোগী, অচল ঘোষিত বা মেয়াদ শেষ হওয়া মোটরযান বিনষ্ট করে ফেলতে একটি নীতিমালার খসড়া চূড়ান্ত করেছে সরকার। নীতিমালা পাস হলে আনফিট বা অচল গাড়ি স্ক্র্যাপ করা যাবে। অর্থাৎ পুনর্ব্যবহারযোগ্য যন্ত্রাংশ আলাদা করে মোটরযানটি ধ্বংস করা যাবে। এর মাধ্যমে সড়কে দুর্ঘটনা ও যানবাহনের দূষণ কমানো সম্ভব হবে।

বিআরটিএর এক হিসাবে বর্তমানে সড়কে চলাচল করা ৪০.৬৬ শতাংশ বাস ধ্বংসযোগ্য অবস্থায় রয়েছে। সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের অধীন সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগ থেকে এই খসড়া চূড়ান্ত করা হয়েছে। খসড়াটি মতামতের জন্য প্রকাশ করা হয়েছে।

সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলো অতি পুরনো ও চলাচলের অনুপযোগী গাড়িগুলোকেই বেশির ভাগ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী করে আসছে। যদিও প্রতিবছর চলাচলের অনুপযোগী বাসগাড়িগুলোর জন্য সড়কে কী পরিমাণ দুর্ঘটনা ও প্রাণহানির ঘটনা ঘটে, এর যথাযথ পরিসংখ্যান নেই। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) এরই মধ্যে স্ক্র্যাপযোগ্য গাড়ির সংখ্যা নির্ধারণ করেছে। 

বিআরটিএর হিসাব অনুযায়ী, সারা দেশে স্ক্র্যাপযোগ্য বাস ও মিনিবাসের সংখ্যা ৩৩ হাজার ১৭৪। অথচ সর্বশেষ গত মে মাস পর্যন্ত দেশে নিবন্ধিত বাস রয়েছে ৫৩ হাজার ৪৮৫টি। মিনিবাস রয়েছে ২৮ হাজার ৮৮টি। বাস-মিনিবাস মিলিয়ে মোট দাঁড়াচ্ছে ৮১ হাজার ৫৭৩টি। এর বিপরীতে ৪০.৬৬ শতাংশ গাড়িই ধ্বংসযোগ্য অবস্থায় রয়েছে। গণপরিবহনের পাশাপাশি পণ্য পরিবহনের অচল গাড়িগুলোও বাধ্যতামূলক স্ক্র্যাপ করা হচ্ছে আইনে। বর্তমানে সারা দেশে নিবন্ধিত ট্রাকের সংখ্যা এক লাখ ৪৯ হাজার ৪৪৪। কাভার্ড ভ্যান রয়েছে ৪৫ হাজার ১৫৯টি। মোট এক লাখ ৯৪ হাজার ৬০৩টি পণ্যবাহী গাড়ির মধ্যে স্ক্র্যাপযোগ্য ৩০ হাজার ৬২৩টি, যা ১৫.৭৩ শতাংশ।

স্ক্র্যাপ নীতিমালা চূড়ান্ত হলে তা বাস্তবায়ন করতে আগে থেকেই পরিবহন মালিক সমিতির নেতাদের সঙ্গে বৈঠকে বসেছে বিআরটিএ। সংস্থাটির পক্ষ থেকে মালিকদের সঙ্গে মৌখিক আলোচনা করা হয়েছে। আসন্ন ঈদুল আজহার পর অচল গাড়ি স্ক্র্যাপ করার উদ্যোগ নিতে পরিবহন মালিকদের আনুষ্ঠানিকভাবে চিঠি দেবে বিআরটিএ।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিআরটিএর সংশ্লিষ্ট এক কর্মকর্তা বলেন, ‘স্ক্র্যাপ করা নিয়ে পরিবহন মালিকদের সঙ্গে আলোচনা শুরু হয়েছে। বৈঠকে তাঁদের কোনো আপত্তি ছিল না। তাঁরাও বিষয়টি ইতিবাচকভাবেই দেখছেন। ১৯৭২ সালে নিবন্ধিত গাড়িও বর্তমানে তালিকায় রয়েছে। স্ক্র্যাপ করা শুরু হলে আমাদের নিবন্ধিত তালিকা হালনাগাদ করার সুবিধা হবে।’

গত ১৭ মে বাণিজ্যিক মোটরযানের মেয়াদ নির্ধারণ করে একটি প্রজ্ঞাপন প্রকাশ করেছে সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের বিআরটিএ শাখা। প্রজ্ঞাপন অনুযায়ী, বাস ও মিনিবাসের চলাচলের মেয়াদ ২০ বছর এবং ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যানের মেয়াদ ২৫ বছর নির্ধারণ করা হয়েছে।

জানতে চাইলে বিআরটিএর চেয়ারম্যান নূর মোহাম্মদ মজুমদার বলেন, ‘নীতিমালা এখনো চূড়ান্ত হয়নি। তবে এখন যেসব গাড়ি আনফিট রয়েছে, সেসব গাড়ি নতুন করে ফিটনেস সনদ পাবে না। পরিবহন মালিকদের এসব গাড়ি সড়কে না নামানোর জন্য নির্দেশ দিয়েছি। ঈদের পর নীতিমালা চূড়ান্ত হলে আনুষ্ঠানিক পদক্ষেপ নেওয়া হবে।’

নীতিমালা চূড়ান্ত হতে কত সময় লাগতে পারে—এমন প্রশ্নে নূর মোহাম্মদ বলেন, জনমত যাচাইয়ের প্রক্রিয়া শেষ হয়েছে। ঈদের পর সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে নিয়ে আবার বসা হবে। প্রতিক্রিয়ার ভিত্তিতে খসড়ায় সংশোধন থাকলে সেটা করা হবে। তারপর নীতিমালা চূড়ান্ত হলে সেটাকে আইনে রূপান্তর করা হবে। আশা করছি, দ্রুতই নীতিমালাটির বাস্তবায়ন হবে।

মোটরযানে স্ক্র্যাপ কী : বিআরটিএ আইন বলছে, মোটরযান স্ক্র্যাপ মানে মোটরযান থেকে পুনর্ব্যবহারযোগ্য যন্ত্রাংশ আলাদা করার পর বিনষ্ট বা ধ্বংস করা। সড়ক পরিবহন আইনের মাধ্যমে গাড়ির মেয়াদ নির্ধারণ করা হয়েছে। বিআরটিএর মাধ্যমে মোটরযান স্ক্র্যাপ করার জন্য ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নিয়োগ করা হবে, যাদের স্ক্র্যাপ ভেন্ডর বলা হবে।

আবার জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের মোটরযান অকেজো ঘোষণা ও নিষ্পত্তির নীতিমালা অনুযায়ী, অকেজো ঘোষিত মোটরযান বলতে আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব নীতিমালা বা সিদ্ধান্ত অনুযায়ী অকেজো যানবাহন এবং সড়কে চলাচল অযোগ্য ব্যক্তি মালিকানাধীন যে কোনো মোটরযান হতে পারে।

বিআরটিএর নিবন্ধিত মোটরযানের তালিকায় দেখা যায়, গত মে পর্যন্ত দেশে মোটরযান রয়েছে ৫৭ লাখ ৪১ হাজার ৮৬৩টি। ২০১০ সাল থেকে গত মাস পর্যন্ত সময়ে নিবন্ধন পেয়েছে ৪৩ লাখ ১৪ হাজার ৪৯৫টি মোটরযান। বাকি ১৪ লাখ ২৭ হাজার ৩৬৮টি মোটরযান এর আগে নিবন্ধন পেয়েছে।

পরিবহন বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক মো. হাদিউজ্জামান বলেন, শুধু নিবন্ধনের সময় ধরে একটি গাড়িকে চলাচল অনুপযোগী ঘোষণা করা ঠিক হবে না। কম বছরেও গাড়িটি বেশি সময় চলতে পারে। এতে গাড়ির অবস্থা দ্রুত খারাপ হওয়ার আশঙ্কা থাকে। তাই সঙ্গে মাইলেজ নির্ধারণ করা যেতে পারে। আর গাড়ির অবস্থা কেমন সেটিও বিবেচনা করা যেতে পারে।

স্ক্র্যাপ ছাড়া নতুন গাড়ি নেওয়া যাবে না : নীতিমালার খসড়ায় বলা হচ্ছে, কোনো যানের মেয়াদ শেষ হলে ওই যান স্ক্র্যাপ করতে হবে। স্ক্র্যাপ করার মতো গাড়ি থাকতে ওই যানের মালিক অন্য কোনো যানের নিবন্ধন পাবেন না।

কিভাবে স্ক্র্যাপ করতে হবে : স্ক্র্যাপ করার পুরো প্রক্রিয়াটি বিআরটিএর তত্ত্বাবধানে বেসরকারি পর্যায়ে হবে। স্ক্র্যাপযোগ্য মোটরযানের মালিক মূল কাগজপত্রসহ নিবন্ধন কর্তৃপক্ষের কাছে হস্তান্তর করবেন। কর্তৃপক্ষ যাচাই-বাছাই শেষে সংশ্লিষ্ট মোটরযান স্ক্র্যাপ ভেন্ডরের কাছে হস্তান্তর করবে। নিয়োগ দেওয়া স্ক্র্যাপ ভেন্ডর কর্তৃপক্ষের প্রতিনিধির উপস্থিতিতে স্ক্র্যাপ কার্যক্রম পরিচালনা করবে।

তবে পরিত্যক্ত মোটরযানের ক্ষেত্রে আদালত, পুলিশ, কাস্টমস বা অন্য যেকোনো সংস্থা যথাযথ প্রক্রিয়া অনুসরণ করে স্ক্র্যাপ করার জন্য অনুরোধ করলে বিআরটিএ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেবে। পুলিশের কাছে আটক করা স্ক্র্যাপযোগ্য মোটরযান বিআরটিএ নিজ উদ্যোগেই স্ক্র্যাপ করতে পারবে। মোটরযানের চেসিস ও বডি এমনভাবে বিনষ্ট করতে হবে, যাতে এগুলো অন্য কোনো মোটরযানে ব্যবহার করা না যায়।

জানতে চাইলে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির সভাপতি মসিউর রহমান রাঙ্গা বলেন, একেবারে আনফিট বাস স্ক্র্যাপ করার সিদ্ধান্ত খারাপ না। তবে এই পদক্ষেপ শুধু গণ ও পণ্য পরিবহনে সীমাবদ্ধ না রেখে ব্যক্তি মালিকাধীন গাড়ির ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হওয়া উচিত।

স্ক্র্যাপ করার যোগ্য যারা : বিআরটিএ উন্মুক্ত বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে প্রতি জেলায় নির্ধারিত সময়ের জন্য এক বা একাধিক স্ক্র্যাপ ভেন্ডর নিয়োগ করবে। তবে স্ক্র্যাপ ভেন্ডর ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান নিবন্ধিত হতে হবে। সে ক্ষেত্রে স্ক্র্যাপ ভেন্ডরের প্রয়োজনীয়সংখ্যক আধুনিক সরঞ্জাম থাকতে হবে। যেমন—গ্যাস কাটার, ক্রেন, শ্রেডার মেশিন, রেকার, হাইড্রলিক প্রেস মেশিনসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি।


সূত্র: কালের কণ্ঠ


প্যা/ভ/ম